Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

দর্শনীয় স্থান

পুরাকীর্তির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

 

রাজা সীতারাম এর রাজপ্রাসাদ

রাজা সিতারাম রায় উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থ, তিনি চিত্র গুপ্তের পুত্র। বিশ্বভানুর বংশে জাত কাস্যপদাস বংশীয়। উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থের মধ্যে বাৎসসিংহ সৌকালীন ঘোষ, বিশ্বমিত্র, মৌদগল্য দাস ও কাস্যপ দেবদত্ত আদি সুরের সময় বঙ্গে আসেন;এই ৫ ঘরই প্রধান বীজ স্বরূপ বলে খ্যাত। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে রাজা মানসিংহ যখন রাজ মহলে রাজধানী স্থাপন করেন, সম্ভবতঃ তখন শ্রীরাম দাস তাঁর নিকট হতে ‘‘খাস বিশ্বাস’’ উপাধী লাভ করেন। তিনি সুবাদারের খাস সেরেস্তায় হিসাব বিভাগে বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলেন। তৎপুত্র হরিশচন্দ্র অল্পবয়সে পিতার সঙ্গে রাজ সরকারে কার্যারম্ভ করেন এবং রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার সঙ্গে ঢাকায় যান (১৬০৯ খ্রীষ্টাব্দে)। তিনি সেখানে কর্মদক্ষতা দেখিয়ে ‘‘রায় বাঁয়া’’উপাধি পান। তৎপুত্র উদয় নারায়ণ ভূষণার ফৌজদারের অধীন সাজোয়াল বা তহশিলদার নিযুক্ত হয়ে ভূষণায় আসেন। ইনিই সীতারামের পিতা। মাগুরা জেলা শহর হতে ১০ মাইল পূর্বে মধুমতি নদীর তটে মাগুরা জেলায় অবস্থিত মহম্মদপুর উপজেলা। এই মহম্মদপুর উপজেলা শহর এলাকায় ছিল রাজা সীতারামের রাজধানী ও বাসস্থান। এটা বৃহত্তর যশোরের একটি গৌরবের স্থান। অবশ্য ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত বোয়ালমারি উপজেলা শহর থেকেও এই স্থানে যাওয়া যায়। বোয়ালমারী বাজার হতে এই স্থান ৬/৭ মাইল পশ্চিমে। সাহিত্য সম্রাট বঙ্গিম চন্দ্রের ‘‘সিতারাম’’ নামক উপন্যাসের সহিত শিক্ষিত বাঙ্গালি মাত্রেই পরিচিত। এই মহম্মদপুরে রাজা সিতারাম রায়ের রাজধানী ছিল। সীতারামের আদিনিবাস ছিল বীরভূম জেলায় জাতিতে তিনি উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থ ছিলেন। তাঁর পিতা উদয় নারায়ণ প্রথমে রাজমহলে নবাব সরকারে কার্য্য করিতেন, পরে ভূষণা পরগণায় তহশিলদার পদে নিযুক্ত হইয়া আসেন। তাঁহার পত্নীর নাম দয়াময়ী।

১৬৫৮ খ্রীষ্টাব্দে সীতারামের জন্ম হয়। উদয়ন নারায়ন ক্রমে একটি ক্ষুদ্র তালুক ক্রয় করেন এবং মধুমতি নদীর অপর পারে হরিহর নগরে বাস করিতে থাকেন।

সীতারামের মাতা দয়াময়ী তেজস্বিনী নারী ছিলেন। কথিত আছে অল্প বয়সে একটি খড়েগর সাহায্যে এক দল ডাকাতকে তিনি পরাস্থ করিয়াছিলেন। মহম্মদপুরে আজও ‘‘দয়াময়ী’’ তলা নামে একটি স্থান দৃষ্ট হয়; এই স্থানে সীতারামের সময়ে বারোয়ারী উৎসব হইতো। সীতারামের অভুত্থান সর্ম্পকে নানারূপ কাহিনী প্রচলিত আছে। কেহ কেহ বলেন যে সপ্তদশ শতকের শেষভাগে বাংলার তদানিন্তন ভৌমিক রাজগণ যথাসময়ে রাজকর না দেওয়ায় দিল্লীর বাদশাহ সীতারামকে তাঁহাদের নিকট হইতে বাকী রাজকর আদায়ের জন্য সৈন্য সামন্তসহ প্রেরণ করেন। সীতারাম আসিয়া তাঁহাদিগকে যুদ্ধে পরাস্ত ও রাজ্যচ্যুত করিয়া স্বয়ং তাহাদের রাজ্য অধিকার করেন এবং পরে বাদশাহের সহিত বিবাদের ফলে তাহার পতন ঘটে। মতান্তরে সীতারাম ভূষণা পরগণার অন্তর্গত মধুমতির পূবর্বপারস্থিত হরিহর নগর নামক একটি তালুকের অধিপতি ছিলেন।

বর্তমান মহম্মদপুরের নিকটবর্তী শ্যামনগর নামক গ্রামেও তাঁহার কিছু ভু-সম্পত্তি ছিল। প্রবাদ, মহম্মদ শাহ নামক স্থানীয় এক ফকিরের নাম হইতে মহম্মদপুর নাম হইয়াছে। সীতারামের প্রভাবে সমগ্র ভুষণা তাঁহার অধিকারভুক্ত হইলো এবং দস্যু সরদার তাঁহার সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইয়া দলবলসহ তাঁহার সেনাবাহিনীতে যোগদান করিল। সীতারাম স্বাধীন রাজার ন্যায় রাজস্ব করিতে লাগিলেন। শীঘ্রই ভূষণার ফৌজদার মীর আবু তোরাপের সহিত তাঁহার সংঘর্ষ উপস্থিত হইলো। সীতারামের সেনাপতি মেনাহাতির হস্তে আবু তোরাপ নিহত হইলেন। মেনাহাতীর প্রকৃত নাম রামরূপ (মতান্তরে মৃম্ময়) ঘোষ। তিনি দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়স্থ ছিলেন। মেনাহাতীর অর্থ ছোটখাট স্ত্রী হস্তি, তাঁহাকে একটি ছোটখাট হাতী বলিয়াই মনে হইতো। আবু তোরাপের মৃত্যু সংবাদ শ্রবণে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ মেনাহাতী ও সীতারামকে দমন করিবার জন্য বক্স আলী খাঁ ও দিঘাপতিয়ার দয়ারাম রায়ের নেতৃত্বে বহু সৈন্য সামন্ত প্রেরণ করিলেন। জনশ্রুতি যে, মহাবীর মেনাহাতী অক্ষয় কবচের অধিকারী ছিলেন; কোনরূপ অস্ত্র দ্বারা তাঁহার দেহ বিদ্ধ হইতো না। একদিন দোল মঞ্চের নিকট দিয়া যাইবার সময় সিতারামের জনৈক বিশ্বাস ঘাতক কর্মচারীর পরামর্শ মত শত্রুসৈন্য তাঁহাকে অতর্কিতভাবে আক্রমন করিয়া বন্দী করিয়া ফেলিল। সাতদিন পর্যন্ত তাহাদের হন্তে নিদারুন নির্যাতন ভোগ করিবার পর আর সহ্য না করিতে না পারিয়া মহাবীর মেনাহাতী স্বীয় অক্ষয় কবচ পরিত্যাগ করেন এবং মৃত্যুকে বরণ করিয়া লন। ১৪১৭ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার মৃত্যু হয়। কথিত আছে যে, তাহার মৃতদেহ হইতে মস্তকটি কাটিয়া লইয়া মুর্শিদাবাদে পাঠানো হয়। মানুষের মাথা যে এত বড় হইতে পারে তাহা দেখিয়া নবাব মুর্শিদকুলি বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং বলেন , ‘যে এরূপ মহাবীরকে কোনভাবেই হত্যা করা উচিত হয় নাই, নবাব মাথাটি সম্ভ্রমে মহম্মদপুরে ফিরাইয়া দিলেন। ইতিমধ্যে সেনাপতির মস্তকহীন দেহ যথারীতি সৎকার করিয়া অন্থি সমাহিত করা হয়;মস্তকটিও তথায় সমাধি করিয়া সীতারাম একটি উচ্চ সমাধি স্তম্ভ নির্মাণ করাইয়া ছিলেন। মেনাহাতীর মৃত্যুর পর সীতারামের পতন ঘটে। যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দি হইয়া তিনি মুর্শিদাবাদে প্রেরিত হন। দয়ারাম রায়ই সঙ্গে করিয়া সীতারামকে মুর্শিদাবাদে লইয়া যান। পথিমধ্যে দিঘাপতিয়ায় যাইবার সময়ে তাহাকে নাটোর রাজবাটির কারাগারে বন্দি করিয়া রাখিয়া যান। মুর্শিদাবাদে কয়েক মাস বন্দী থাকিবার পর তিনি মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হন। কেহ কেহ বলেন, তিনি বিষ পানে আত্মহত্যা করেন। মুর্শিদাবাদে গঙ্গাতীরে তাঁহার শ্রাদ্ধ হইয়াছিল।

মহম্মদপুরে সীতারামের বহু কীর্তি আজিও বিদ্যমান আছে। উহাদের মধ্যে প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ, রাম সাগর, সুখ সাগর ও কৃষ্ণসাগর নামে দীঘি, দোল মঞ্চ ও রাজভবনের ধ্বংসাবশেষ সিংহদরওজা, মালখানা, তোষাখানা, দশভুজা মন্দির, লক্ষ্মী নারায়ণের অষ্টকোন মন্দির, কৃষ্ণজীর মন্দির প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অতীতে এই দুর্গের চর্তুদ্দিকস্থ খাত দিয়া মধুমতির স্রোত প্রবাহিত হইতো। সীতারামের দুইটি প্রধান বড় কামানের নামকরণ হইয়াছিল কালে খাঁ ও ঝুম ঝুম খাঁ। রামসাগর দীঘিটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৫০০ ফুট ও প্রস্থে ৬০০ ফুট। ইহার জল এখনও প্রায় নির্ম্মল ব্যবহারোপযোগী আছে। কৃষ্ণসাগর দিঘীটি মহম্মদপুর দুর্গের দক্ষিণ পূবর্ব দিকে কানাই নগর গ্রামে অবস্থিত।

সীতারামের পতনের পর ভূষণা রাজ্য নাটোর রাজ বংশের সম্পত্তিতে পরিনত হয়।

মহম্মদপুর সমৃদ্ধির সময়ে মধুমতি নদী এই স্থানের প্রান্ত দিয়া প্রবাহিত ছিল। বর্তমানে নদী প্রায় দুই মাইল দূরে সরিয়া গিয়াছে। ১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দে এক ভীষণ মহামারীর ফলে মহম্মদপুর একেবারে বিধ্বস্ত হইয়া যায়। এবং তাহার পর হইতে ক্রমশঃ ইহা একটি নগন্য পন্ডগ্রামে পরিনত হয়। বাগের হাটের খাঁন জাহান আলী মতো সীতারামেরও একদল বেলদার সৈন্য ছিল। কথিত আছে, সংখ্যায় এরা ২২০০ ছিল এবং যুদ্ধের সময় ছাড়া অন্য সময়ে জলাশয় খনন করিয়া লোকের জলকষ্ট দুর করাই তাহাদের কাজ ছিল। কথিত আছে, সীতারাম প্রতিদিন নবখনিত জলাশয়ের জলে স্নান করিতেন এবং এই জন্য প্রতিদিন রাজ্যের বিভিন্ন স্থান হইতে রাজধানীতে জল আনা হইতো। এইরূপে তিনি বহু পুস্করিণী প্রতিষ্টা করিয়া গিয়াছেন।

সীতারামের সৈন্যদলে বহু মুসলমান ছিলেন। কথিত আছে, তিনি মুসলমান সেনাপতিদিগকে ভাই বলিয়া ডাকিতেন এবং হিন্দু মুসলমানের মিলনের জন্য সতত চেষ্টিত ছিলেন। গ্রাম্য কবিদের গানে ও গাঁথায় ইহার প্রমাণ আজও পাওয়া যায়।



যাতায়াত: মাগুরা সদর হতে ২৮ কি.মি. দূরে মহম্মদপুর উপজেলায় রাজাবাড়ী নামক স্থানে রাজা সীতারাম রায়ের বাড়িটি অবস্থিত। মহম্মদপুর বাস স্ট্যান্ড হতে আধা কিলোমিটার উত্তরে পাকা রাস্তার পার্শ্বে রাজবাড়ির অবস্থান। রিক্সা, ভ্যান অথবা পায়ে হেটে যাতায়াত করা যায়।